Monday, October 10, 2011

নিউট্রিনো ছোটে আলোর চেয়ে বেশি গতিতে?


আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো আদর্শ মডেল নামের একটি তত্ত্ব। এই মডেল অনুসারে মৌলিক কণাগুলো তিন প্রকার—কোয়ার্ক, বোসন, লেপটন। এর মধ্যে লেপটন দুই প্রকার—ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো। নিউট্রিনোর ধারণা প্রথম বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন পরমাণুর বেটা ক্ষয়ের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে। বেটা ক্ষয়ের মাধ্যমে পর্যায় সারণির একটি পদার্থের পরমাণুর কেন্দ্র থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয় এবং পরমাণুটি পর্যায় সারণির পরবর্তী পদার্থে পরিণত হয়। বিজ্ঞানী পাউলি দেখলেন যে ভরবেগ, শক্তি, কৌণিক ভরবেগ ইত্যাদির নিত্যতা বজায় রাখার জন্য ইলেকট্রনের সঙ্গে আরেকটি খুবই হালকা, আধানহীন এবং প্রায় অদৃশ্য কণার উপস্থিতি প্রয়োজন—এই কণাটিরই নাম দেওয়া হয় নিউট্রিনো। নিউট্রিনো এবং ইলেকট্রন প্রকৃতিতে দুই ভাইয়ের মতো। তিন ধরনের ইলেকট্রন আছে—ইলেকট্রন ইলেকট্রন (অথবা শুধুই ইলেকট্রন), মিউ ইলেকট্রন (মিউয়ন), টাউ ইলেকট্রন (টাউয়ন); এর প্রতিটির সঙ্গে আছে একটি করে নিউট্রিনো—ইলেকট্রন নিউট্রিনো, মিউ নিউট্রিনো, টাউ নিউট্রিনো। নিউট্রিনোর উপস্থিতি টের পাওয়া খুবই কঠিন। কারণ, এর ভর অতি সামান্য, কোনো আধান নেই এবং অন্যান্য পদার্থের সঙ্গে এর বিক্রিয়াও খুবই ক্ষীণ। এমনকি ঠিক এ মুহূর্তে আপনার শরীর ভেদ করে হাজার কোটিরও বেশিসংখ্যক নিউট্রিনো যাচ্ছে, কিন্তু আপনি বুঝতেও পারছেন না। পৃথিবীতে আগত নিউট্রিনোর মূল উৎস সূর্যের অভ্যন্তরে ফিউশন বিক্রিয়া। নিউট্রিনোর ভর এখনো সুনির্দিষ্ট নয়, এখন পর্যন্ত আমরা যতটুকু জানি তা হলো, এই তিন ধরনের নিউট্রিনোর ভর যথাক্রমে সংশ্লিষ্ট ইলেকট্রনের ভরের দুই লাখ ভাগের এক ভাগ, ৬০০ ভাগের এক ভাগ, ১১০ ভাগের এক ভাগ হতেও কম। তবে অনেকের মতে নিউট্রিনোর আসলে কোনো ভরই নেই, অর্থাৎ আলোর মতো ভরহীন।

নিউট্রিনোর গতি
নিউট্রিনো যদি আসলেই ভরহীন হয়, তাহলে আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী তার গতি হবে আলোর গতির সমান, আর যদি ভর থাকে, তাহলে গতি হবে আলোর গতির চেয়ে কম। কিন্তু অপেরা পরীক্ষণের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে নিউট্রিনোর গতি হলো আলোর গতির ১.০০০০২৫ গুণ (০.০০২৫ শতাংশ বেশি)। , আবিষ্কারে নির্ভুলতা যাচাই করা এবং আবিষ্কারটি ব্যাখ্যা করা যায়—এমন গাণিতিক তত্ত্ব হাজির করা।

প্রজেক্ট অপেরা
এই পরীক্ষাটির প্রথম ধাপে সুইজারল্যান্ডের সিনক্রোটোন নামের একটি ভূগর্ভস্থ যন্ত্রে প্রোটন কণা তৈরি করে গ্রাফাইটের ওপর নিক্ষেপ করা হয়। এতে প্রোটন কণাগুলা ভেঙে কিছু অন্তর্বর্তীকালীন জটিল কণা তৈরি হয়, যেগুলো অল্প সময়ের মধ্যেই ক্ষয় হয়ে মিউয়ন এবং মিউ নিউট্রিনো তৈরি করে। এই কণাগুলোকে তখন লোহার ওপর নিক্ষেপ করা হয়। এতে মিউয়ন নিউট্রিনো বাদে অন্য সব কণা প্রতিফলিত বা শোষিত হয়, কিন্তু নিউট্রিনোগুলো লোহা ভেদ করে চলে যেতে পারে। এই নিউট্রিনোগুলো তারপর পৃথিবীর মাটি-পাথর ভেদ করে প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার দূরে ইতালিতে পৌঁছায়, যেখানে বিজ্ঞানীরা এই বিশেষ নিউট্রিনোর আগমন সময় লিপিবদ্ধ করেন। সূর্য থেকে আগত বিপুলসংখ্যক নিউট্রিনোর সঙ্গে এই নিউট্রিনোর পার্থক্য করা সহজ। কারণ, সূর্যের নিউট্রিনোগুলো হলো ইলেকট্রন নিউট্রিনো, যার ভর এই মিউয়ন নিউট্রিনোগুলোর ১০ হাজার ভাগের এক ভাগ। ভূগর্ভের বিভিন্ন ধরনের পদার্থ ভেদ করে আসার সময় এই নিউট্রিনো বা তার গতির কোনোই পরিবর্তন হয় না। বিজ্ঞানীরা সহজে এই বিশেষ পর্যটকের গতি নির্ধারণ করেন।

পরীক্ষণের নির্ভুলতা
প্রথমত আসে পরিমাপের নির্ভুলতার কথা। নিউট্রনগুলো আলোর গতিতে ভ্রমণ করলে সুইজারল্যান্ড থেকে ইতালিতে আসতে যে সময় লাগত, প্রকৃত পরীক্ষায় তার চেয়ে মাত্র ৬০ ন্যানোসেকেন্ড (১ ন্যানোসেকেন্ড = ১ সেকেন্ডের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ) আগে পৌঁছেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এই প্রায় কল্পনাতীত ক্ষুদ্র পার্থক্য কি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে? উত্তর, হ্যাঁ। অপেরা পরীক্ষার অংশ হিসেবে করা বিভিন্ন পরিমাপ এতটাই নিখুঁত যে ২০০৯ সালে সংঘটিত একটি ভূমিকম্পের ফলে সুইজারল্যান্ড ও ইতালির মধ্যবর্তী দূরত্বে যে পরিবর্তন হয়েছে, তাও হিসাবে নেওয়া হয়েছে। ইন্টারনেটে প্রকাশিত তথ্যগুলোতে ঠিক ভূমিকম্পের সময় নিউট্রিনগুলোর যাত্রাকালে বড় ধরনের পরিবর্তন ধরা পড়ে, যার কারণ হলো ভূমিকম্পের ফলে মাটি সরে যাওয়ায় দূরত্বের পরিবর্তন।
যেকোনো বিজ্ঞান পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার পর প্রথম কাজই হলো, পরীক্ষাটির ভুলত্রুটি দূর করা। এ ধরনের সমস্যা দূর করার জন্য বিজ্ঞানীরা যা করেন তা হলো, একই পরীক্ষা বারবার করা। বিভিন্ন কারণে পরীক্ষার ফলাফল সব সময় একই আসে না, তখন ফলাফলের গড় করা হয় এবং ভুলের আশঙ্কা হিসাব করা হয়। অপেরা পরীক্ষায় নিউট্রিনোর গতি পরিমাপ করা হয়েছে কয়েক বছর সময় নিয়ে প্রায় ১৬ হাজার বার এবং তারপর গড় যে ফলাফল পাওয়া গেছে, ভুলের আশঙ্কা গণ্য করার পরও তার গতি আলোর গতির চেয়ে বেশি!
এখন বাকি থাকল আসলে পরীক্ষাটিতেই অন্তর্নিহিত কোনো ভুল আছে কি না তা যাচাই করা। বিভিন্ন কারণে পরীক্ষার ডিজাইনের মধ্যেই ভুল থেকে যেতে পারে। যেমন, একটি থার্মোমিটার দিয়ে শিশুর জ্বর মাপার সময় যদি মায়ের নিজের আঙুলই থার্মোমিটারে অগ্রভাগকে স্পর্শ করে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সঠিক জ্বর পাওয়া যাবে না। এটি হলো পরীক্ষার ডিজাইনের একটি ভুল। যেকোনো পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণের সময় বিজ্ঞানীদেরও এ ধরনের ভুলের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হয়। অপেরা পরীক্ষাটিতে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো ভুল পাওয়া যায়নি। পরীক্ষকেরা তাই তাঁদের সব তথ্য ইন্টারনেটে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন।
আরেকটি ধাপ হলো, সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো পরীক্ষায় একই ফলাফল পাওয়া যায় কি না, তা যাচাই করা। শুধু একটি পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা খুব বেশি উৎসাহী নন। এ ক্ষেত্রে একটি সুখবর হলো, কয়েক বছর আগেই শিকাগোর ফার্মিল্যাবে নিউট্রিনো-সংক্রান্ত আরও কিছু পরীক্ষা করা হয়েছিল। এখন সেই পরীক্ষায় পাওয়া তথ্যগুলো পুনরায় বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। 

তত্ত্ব
অপেরার ফলাফল যদি সত্যি প্রমাণিত হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তা পদার্থবিজ্ঞানে একটি বিপ্লব সৃষ্টি করবে। এ ঘটনা এবং সার্নের বিশাল হ্যাড্রন সংঘর্ষক নামক যন্ত্রের উচ্চশক্তি পরীক্ষাগুলোর প্রতিক্রিয়া গত শতাব্দীর শুরুর দিকে পদার্থবিজ্ঞানের যে নবযুগ সৃষ্টি হয়েছিল, তাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে অনেকের ধারণা। এ ঘটনার ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন নতুন-পুরোনো তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। নিউট্রিনোর এই আপাত গতি আইনস্টাইনের তত্ত্বের পরিপন্থী। তবে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানের অত্যন্ত গভীরে নিমজ্জিত এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ সফল (অন্য কোনো তত্ত্বের এ ধরনের সাফল্যের রেকর্ড নেই) হওয়ায় বিজ্ঞানীরা প্রাথমিকভাবে একে রক্ষা করেই নতুন তত্ত্বের প্রবর্তনের চেষ্টা করছেন।
একটি সম্ভাব্য তত্ত্ব হলো, স্ট্রিং থিওরি। স্ট্রিং থিওরি প্রস্তাব করে যে মহাবিশ্বে আমাদের দৃষ্টিগোচর স্থান-কাল ছাড়াও আরও অনেকগুলো মাত্রা আছে। কোনো কোনো উচ্চ শক্তিবিশিষ্ট কণা (যেমন, অপেরার মিউ নিউট্রিনোগুলো) এই বাড়তি মাত্রাগুলোকে স্থান-কালের মধ্যে বিচরণের জন্য চোরাগলি বা শর্টকাট হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমাদের কাছে (আমাদের পর্যবেক্ষণ স্থান-কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ) কণাটির গতি প্রকৃত গতির চেয়ে বেশি মনে হবে। এ ব্যাখ্যা আইনস্টাইনের তত্ত্বকে রক্ষা করেই নিউট্রিনোর আপাত গতি ব্যাখ্যা করতে পারে।
আরেকটি সম্ভাব্য তত্ত্ব হলো, সিমেট্রি ব্রেকিং (সুষমতা ভঙ্গ)।  ‘লরেঞ্জের সুষমতা’-এর আবিষ্কর্তা বিজ্ঞানী লরেঞ্জের সম্মানে নামকৃত। লরেঞ্জের সুষমতার মূলনীতি হলো, পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো পর্যবেক্ষক নিরপেক্ষ। মহাবিশ্বের অন্য সুষমতাগুলো কিছু বিশেষ প্রক্রিয়ায় ভঙ্গ হতে পারে; তবে লরেঞ্জের সুষমতা ভঙ্গের কোনো দৃষ্টান্ত এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে যদি কোনো ক্ষেত্রে লরেঞ্জের সুষমতা ভঙ্গ হয়, তাহলে সেখানে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রযোজ্য হবে না। যদি তা-ই হয়, তাহলে বস্তুর গতি আলোর গতির বেশি সেটা যা-ই হোক, বিজ্ঞানের চমৎকারিত্ব যে নতুন নতুন দিকে সব সময় ডানা মেলছে সার্নের এ পরীক্ষা হলো তার বড়ো প্রমাণ। 
কাজে তত্ত্বের বেড়াজাল ডিঙিয়ে শেষ পর্যন্ত জয় হবে বিজ্ঞানের, মানুষের কৌতুহলের ও মহাবিশ্বকে জানার দারুণ আগ্রহের।

No comments:

Post a Comment