Sunday, February 26, 2012

আইফোন-অ্যানড্রয়েডের অ্যাপ্লিকেশন বাংলাদেশেও তৈরি হচ্ছে

মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন বর্তমান সময়ের আলোচিত সফটওয়্যার। এ সফটওয়্যার ব্যবহার করে মোবাইল ফোনে নানা ধরনের খেলা ও মিউজিক ডাউনলোড এবং বিজ্ঞাপন দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজ করা যায়। অ্যাপলের আইফোন, গুগলের অ্যানড্রয়েড, নকিয়া ও ব্ল্যাকবেরিসহ বিশ্বের নামিদামি মোবাইল ফোনে এ সফটওয়্যার প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত এ সফটওয়্যার তৈরিতে এগিয়ে রয়েছে। এগিয়েছে বাংলাদেশও।
সম্প্রতি স্মার্ট ফোনের ব্যাপক প্রসার ঘটায় বিশ্বব্যাপী অ্যাপ্লিকেশনের বিশাল বাজার সৃষ্টি হয়েছে। এ বাজারে নিজেদের জায়গা করে নিতে সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশের সফটওয়্যার উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো। দেশের মেধাবী ও দক্ষ জনবলকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের নামিদামি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।
আশার কথা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মতো উন্নত দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করছে বাংলাদেশের সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। বিদেশে এসব অ্যাপ্লিকেশনের ব্যাপক জনপ্রিয়তাও রয়েছে। বিশ্বের তিন কোটির বেশি গ্রাহক বাংলাদেশের অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করছেন বলে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন। ভবিষ্যতে এর চাহিদা আরো বাড়বে বলে তাঁদের ধারণা। বর্তমানে ভারতের তৈরি অ্যাপ্লিকেশনের ডাউনলোডের সংখ্যা ১০ কোটি।
সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমিতি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস বা বেসিসের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ৬০টির মতো প্রতিষ্ঠান মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করছে। এর মধ্যে বেসিসের সদস্য প্রতিষ্ঠান ৪৬টি। এ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ৫০০ অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, যা থেকে বছরে প্রায় ২৩ কোটি ডলার আয় করছে এ প্রতিষ্ঠানগুলো।
বাংলাদেশে প্রথম আইফোন ও আইপ্যাড টাচ অ্যাপ্লিকেশন তৈরির কাজ শুরু করে যেসব প্রতিষ্ঠান সেগুলোর মধ্যে রাইজআপ ল্যাবস লিমিটেড অন্যতম। ২০০৯ সালের অক্টোবরে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ঢাকার উত্তরায় ছোট একটি কার্যালয় নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন এর প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এরশাদুল হক। অল্প সময়ে এ খাতের সর্বাধিক উপার্জনকারী প্রতিষ্ঠানের একটিতে পরিণত হয় রাইজআপ ল্যাবস। বর্তমানে সারা বিশ্বে তাদের দুই কোটির বেশি ডাউনলোডকারী রয়েছে।
দেশে এ ধরনের কাজ শুরু হয় মূলত ২০০৫ সালের দিকে। তখন হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এ কাজ শুরু করে। তবে এর সফলতা আসতে শুরু করে ২০০৯ সালের দিকে।
এ বিষয়ে রাইজআপ ল্যাবসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এরশাদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজেদের উদ্যোগে কাজ শুরু করে। পরে কিছু প্রতিষ্ঠান এসব অ্যাপ্লিকেশন তৈরি শুরু করে বিদেশি কম্পানির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে। এসব অ্যাপ্লিকেশন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অ্যাপল, গুগল, নকিয়া, স্যামসাং ও ব্ল্যাকবেরিসহ নামিদামি বিভিন্ন ফোন কম্পানি এ অ্যাপ্লিকেশনের বড় ক্রেতা। এর মাধ্যমে বছরে ২০ থেকে ২৩ কোটি ইউএস ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে বলে জানান তিনি।
তিনি আরো জানান, রাইজআপ ল্যাবসের ১০০টির বেশি অ্যাপ্লিকেশন রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে ৬০ জন দক্ষ সফটওয়্যার ডিজাইনার ও প্রোগ্রামার কাজ করছেন। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশে সেরা দশের তালিকায় উঠে এসেছে রাইজআপের কোনো কোনো অ্যাপলিকেশন। এর কোনো কোনো অ্যাপ্লিকেশন প্রায় ৭০ হাজার ডলারে বিক্রি হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বছরে প্রায় ১০ লাখ ডলার আয় করছে। এ খাতের আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান জেনুইটি সিস্টেম লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ৩৭০টি অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার রয়েছে। তবে এ প্রতিষ্ঠান মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের বাইরে অন্যান্য সফটওয়্যারও তৈরি করে থাকে।
আরো যেসব প্রতিষ্ঠান এ খাতে ভালো কাজ করছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রলগ বাংলাদেশ লিমিটেড, সেন্টিনেল বিডি লিমিটেড, লিভিও ও টেকনোবিডি ওয়েব সলিউশনসহ (প্রাইভেট) বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের গড়ে ১৫ থেকে ২০টি করে অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার রয়েছে। এ অগ্রগতিকে দেশের সফটওয়্যার উন্নয়ন ও আউটসোর্সিং খাতের নতুন একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করছেন উদ্যোক্তারা।
দেশে অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার তৈরির অগ্রগতি সম্পর্কে কথা হয় লিভিওর প্রতিষ্ঠাতা হাসিন হায়দারের সঙ্গে। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, এ খাতে বর্তমানে বেশ ভালো কাজ হচ্ছে। আইফোন ও অ্যানড্রয়েডের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার উপযোগী অনেক জনপ্রিয় অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপ করতে সক্ষম হয়েছে এ প্রতিষ্ঠানগুলো। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে এ ব্যবসা থেকে বেশ ভালো উপার্জনের সুযোগ রয়েছে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তবে এ খাতের বর্তমান সংকট ও প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে সেগুলোকে দূর করার দাবি জানান এই সফটওয়ার ব্যবসায়ী।
উদ্যোক্তারা বলছেন, দক্ষ জনশক্তির অভাব এ খাতের ব্যবসা সম্প্রসারণের সবচেয়ে বড় বাধা। এর ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ছোট উদ্যোক্তারা। কেননা বড় উদ্যোক্তাদের পক্ষে একটু বেশি বেতনে লোক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হলেও ছোট উদ্যোক্তারা তা পারছেন না। ফলে এ খাতের ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রথম দিকে বেশ চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে। এ বিষয়ে টেকনোবিডি ওয়েব সলিউশনের (প্রাইভেট) ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ ইমরুল কায়েস কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশে অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যারের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। তবে এর জন্য এখনই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। ভবিষ্যতে এ খাতের দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি পূরণে আগে থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্প্রসারণ করতে হবে। এ জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি। পাশাপাশি এ খাতে ক্যারিয়ার গঠনে আগ্রহীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান ইমরুল কায়েস।
কায়েস আরো বলেন, 'দেশের সফটওয়্যার ডেভেলপারদের তৈরি অ্যাপ্লিকেশন বিশ্ব বাজারে জায়গা করে নিলেও দেশের বাজারে এর থেকে উপার্জন করার ক্ষেত্র এখনো তৈরি হয়নি। অথচ এ খাতে স্থানীয় গ্রাহকদের কাছ থেকে অনেক বেশি উপার্জনের সুযোগ রয়েছে।' তিনি আরো বলেন, 'আমাদের দেশের গ্রাহকদের রুচি সম্পর্কে আমরাই ভালো জানি। তাঁদের ব্যবহার উপযোগী অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা আমাদের জন্য বেশ সহজ। কিন্তু দেশে এখন পর্যন্ত এ খাত থেকে উপার্জিত অর্থ তুলে আনার পথ বের করা যায়নি।' তবে মোবাইল কনটেন্ট প্রোভাইডারদের মত, মোবাইল অপারেটর কম্পানি কিংবা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে ট্যারিফ (মূল্য) নেওয়ার ব্যবস্থা করা গেলে এ খাতটিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।